পরিবেশের উপকারী প্রাণী। জাতে বিড়াল, প্রাণীটির নাম মেছো বিড়াল। এটি কৃষকের বন্ধু কৃষি সুরক্ষায়ও মেছো বিড়াল বা বন বিড়ালের গুরুত্ব অপরিসীম। ফসল ধ্বংসকারী কৃষকের পরম শত্রু ইদুর দমনে মেছো বিড়াল বা বন বিড়াল অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। বন বিড়ালের গায়ের রং ধানের রঙের সাথে মিল থাকায় তারা দারুণ একটা camouflage বা ছদ্মবেশ ধারণ করে যা ইঁদুরের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। মুহূর্তেই ধরাশায়ী। বন বিড়ালের এই ছদ্মবেশ ইদুর দমনে সফলতার হার অনেক বেশি। অথচ কৃষকের সেই পরম উপকারী বন্ধুকে হত্যায় অনেক ক্ষেত্রে কৃষকরাও দায়ী।
ধানের মৌসুমে ইদুর দমনের আশায় ধান ক্ষেতে বন বিড়াল বা মেছো বিড়াল অবস্থান করে এবং বাচ্চাও দেয়। ধান কাটার সময় দল বেধে সেই কৃষকরাই মেছো বিড়াল বা বন বিড়াল হত্যায় মেতে ওঠে। অনেক সময় খাবারের লোভে লোকালয়ে এসে মারা পড়ছে প্রচুর পরিমাণে মেছো বা বন বিড়াল। শিয়াল, গুইসাপ, সাড়েল, গন্ধগোকুল, খাটাশ, বেজি ইত্যাদি এ সকল বন্য প্রাণী যারা সকলেই কৃষি সুরক্ষায় নিয়োজিত। এসকল বন্য প্রাণী কমে আশায় ইদুরের উৎপাত বৃদ্ধি এবং ব্যাপক ফসলহানি ঠেঁকাতেও ব্যবহার করা হচ্ছে কারেন্ট ফাঁদ। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে সেই কারেন্টের ফাঁদে অবশিষ্ট বেঁচে থাকা বন্য প্রাণীগুলোও মারা যাচ্ছে। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে এই ফাঁদে গত কয়েক বছরে কৃষক পুলিশসহ প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ইদুর দমনে নানা ফাঁদ, বিষ টোপ কোনো পদ্ধতিই ইদুর দমনে কার্যকরী স্থায়ী কোনো সমাধান আসছে না। প্রকৃতিতে food chain বা খাদ্য শৃঙ্খল নামে একটি নিয়ম আছে, সেটাই কৃষি সুরক্ষায় সর্বোত্তম পদ্ধতি। ইদুর দমনে এসকল বন্য প্রাণীর বিকল্প পরিবেশবান্ধব নিরাপদ পদ্ধতি আর হতে পারে না। এই প্রাণীগুলো ছাড়া পৃথিবীর কোনো উন্নত টেকনোলজি ইঁদুর দমনে শতভাগ নিরাপদ সফলতা দেখাতে পারবে না।
ধরে নিন আপনি ইদুর দমনে কোটি কোটি রোবট তৈরি করলেন, সেই রোবট সেন্সরের মাধ্যমে ইঁদুরের গর্ত শনাক্ত করে ইঁদুর দমন করতে গেলো, সেই রোবট ধান, লতাপাতা, কাঁদা পানিতে বিকল হয়ে পড়বে। আপনাকে আরও কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোটি কোটি রোবট তৈরি করতে হবে।
কিন্তু এসকল প্রকৃতির যিনি স্রষ্টা তিনি আপনার চেয়ে অনেক বড় এবং উত্তম কারিগর। তিনি ইঁদুর দমনে যে সকল প্রাণী যেমন সাপ, গুইসাপ, শিয়াল, খাটাশ, গন্ধগোকুল, বেজি, বন বিড়াল, মেছো বিড়াল, হুতোম পেঁচাসহ আরও বেশ কিছু প্রাণী সৃষ্টি করে এই কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন। রোবটরা কি তার চেয়ে উন্নত? এবং রোবট বারবার তৈরি করা লাগবে কিন্তু এসকল প্রাণী মহান প্রতিপালক একবার সৃষ্টি করে পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়েছেন আমরা যদি এদেরকে হত্যা না করি তবে আজীবন এরা কপি পেস্ট করার মতো করে একের পর এক প্রজন্ম তৈরি করে রেখে যাবেন। এখানে কি রোবট কারখানার মতো করে আপনার কোনো বিনিয়োগ করা লাগছে?
এরা কি আপনার শত্রুকে দমনের মাধ্যমে নিজের জীবিকা ও বংশবিস্তার করতে সক্ষম নন?
১১ অক্টোবর ২০২২ প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদনে কৃষি সচিব মোঃ সায়েদুল ইসলাম বলেছেন, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে ধান উৎপাদন হয়েছে মোট ২ কোটি ৭ লাখ টন। খাদ্য উৎপাদনে বড় হুমকি ইঁদুর। ৫-১২% পর্যন্ত ফসলহানি করে।
তাহলে বাৎসরিক উৎপাদন যদি ২ কোটি টন আসে। মোট ৮ শতাংশ ধান বিনষ্ট হলে ২ কোটি টনে ১৬ লাখ টন ধান বিনষ্ট হয়।
তাহলে ৩২৫০০ টাকা প্রতি টনের মুল্য হলে মোট কত টাকা আসে?
আমি অংকে কাঁচা একজন হিসেব করে বললো মোট ৫ হাজার ১ শত ২০ কোটি টাকা আসে, মানে বছরে ইদুরে এতো টাকার ফসলহানি করে।
এবার হিসাব করুন হাঁস মুরগী খাবার ফলে আমরা যে এসকল বন্য প্রাণী হত্যা করি তারা বছরে কত টাকার হাঁস মুরগী খায়? এর ৫০ ভাগের ১ ভাগ হবে?
আমাদের অজান্তেই এই বন্য প্রাণীরা আমাদের কত হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল রক্ষা করছে একবারও ভেবে দেখেছেন?
এক জোড়া ইঁদুর থেকে বছরে প্রায় তিন হাজার ইঁদুরের জন্ম হতে পারে। ফসলের প্রায় ৬০ ধরণের রোগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রোগের কারণ এ প্রাণী।
ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। সামনে বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আমাদের খাদ্যে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। যাতে উদ্বৃত্ত খাদ্য দিয়ে আমরা সারা বিশ্বের পাশে দাঁড়াতে পারি।
এসব বিষয়ে সব থেকে বেশি সচেতন হতে হবে কৃষকদের। কৃষি অধিদপ্তর বন্য প্রাণী সংরক্ষণে কৃষকদের মাঝে জনসচেতনতা তৈরিতে তেমন উল্লেখযোগ্য৷ ভূমিকা পালন করছে বলে আমাদের মাঠ জরিপে প্রতিয়মান হয়নি।
এ বিষয়ে বন বিভাগ জনসচেতনতায় স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন তবে কৃষি অধিদপ্তরের কর্মসূচি নিয়ে আমরা হতাশ।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, পরিবেশবাদী সেচ্ছাসেবী সংগঠন আলোর মিছিল।
খুলনা গেজেট/এনএম